
পেশায় সাংবাদিক। মাঠে ঘাটে, পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে তথ্য নিয়ে তৈরি করেন জীবন যুদ্ধে হার না মানা উদ্যোক্তাদের গল্প। সেই সব গল্প থেকে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে সফল উদ্যোক্তার গল্পে পরিণত হয়েছেন ওই সাংবাদিক। তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি তাঁর নিজ গ্রামের বাড়িতে গরু মোটাতাজাকরণ, মাছ চাষ, বস্তায় আদা চাষ ও দেশি মুরগি পালন করে শুধু নিজের জীবনই বদলে দেননি, বরং আশেপাশের অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। এলাকার মানুষের কাছে সফল উদ্যোক্তার গল্পে পরিণত হয়েছেন।
নীলফামারী জেলার এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম জুয়েল আহমেদের। পুরো নাম আনজারুল ইসলাম জুয়েল। জুয়েল আহমেদের হাতেখড়ি পেশাগত জীবন শুরু হয় বাবা প্রভাষক তোফাজ্জল হোসেনের নিজ হাতে গড়া স্থানীয় সাপ্তাহিক নীলসাগর দিয়ে । ন্যায়ের পথে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। এরপর বিভিন্ন পত্রিকা ও চ্যানেলে ছিলেন নীলফামারী প্রতিনিধি। পরবর্তীতে তিনি চ্যানেল'২৪ চ্যানেলের রংপুর অফিস প্রধানের কাজ করেছেন।বর্তমানে তিনি বাংলা'ভিশন চ্যানেলের উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন সংবাদমাধ্যমে। তবে সাংবাদিকতা জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বরাবরই ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। সে সময় তার বিভিন্ন জীবন যুদ্ধের উদ্যোক্তাদের স্টোরির চিত্র ফুটে উঠে চোখে। সেই থেকে নিজের জীবনে ভিন্ন কিছু করার ভাবনা আসে তার মনে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ছোট আকারে খামার গড়ে তোলার চিন্তা করেন তিনি। তিনি বলেন, "সংবাদপত্রে কাজ করতে গিয়ে কৃষি ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছি। তখনই ভাবনায় আসে, কিছু করার। সেটাই আমার অনুপ্রেরণা।
জন্মস্থান নীলফামারীর রামনগর ইউনিয়নের চাঁদের হাটের দেওয়ানী পাড়ায় নিজের বসতবাড়ির খালি জায়গা থেকেই শুরু হয় জুয়েলের নতুন পথচলা। বাড়ির উঠোন, ফাঁকা জায়গায় প্রথমে শুরু করেন দেশি গরুর মোটাতাজাকরণ প্রকল্প।‘নাম দেয়া হয় ‘নিবিড় অ্যাগ্রো ও ডেইরি ফার্ম’। করেছেন সরকারি নিবন্ধনও। দুইটি গরু দিয়ে শুরু করে এখন তার খামারে গরুর সংখ্যা ১৫ এর বেশি। বিশেষভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু লালনপালন করেন তিনি, যাতে কম খরচে ভালো মুনাফা পাওয়া যায়। এ কাজে নীলফামারী জেলা ও উপজেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তা এবং চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। গরুর খামারের পেছনেই তৈরি করেন একটি বড় পুকুর, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন তিনি। তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, সিলভার কার্পসহ নানা জাতের মাছ রয়েছে তার পুকুরে। স্থানীয় বাজারে এই মাছের চাহিদা ব্যাপক। সপ্তাহে একাধিকবার স্থানীয় বাজারে মাছ সরবরাহ করেন তিনি।
এছাড়াও পলিব্যাগে বা বস্তায় আদা চাষ করে চমক দেখিয়েছেন জুয়েল। সামান্য জায়গায় কীভাবে আদা চাষ করে লাভবান হওয়া যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। তার বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বস্তায় বেড়ে উঠছে আদার গাছ, যেগুলো থেকে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। আদা চাষে ‘মসলার উন্নতজাত, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, প্রকল্প সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হটিকালচার সেন্টার বুড়িরহাট রংপুর’ এ কাজে সহযোগিতা করেছে।
জুয়েলের উদ্যোগের আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে দেশি মুরগি পালন। বাড়ির উঠানে ঘেরা পরিবেশে দেশি জাতের মুরগি লালনপালন করে বাজারজাত করছেন তিনি। মুরগির মাংস ও ডিম স্থানীয়ভাবে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখেন। নির্ভেজাল দেশি মুরগির মাংস ও ডিমের স্বাদ গ্রহণ করছেন পরিবারসহ আশপাশের সবাই।
তিনি বলেন, “দেশি মুরগি পালন করতে গেলে একটু সময় ও যত্ন লাগে, তবে বাজারে এর দাম অনেক বেশি। তাই আমি এটা নিয়মিত করছি। স্থানীয় নারীরাও এখন আমার কাছ থেকে শিখে নিজেদের বাড়িতে ছোট ছোট খামার গড়ে তুলছেন।”
জুয়েল আহমেদ আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করতেও দক্ষ। ইউটিউব, কৃষিভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ ও সরকারি কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে নিজের খামারে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেন তিনি। যেমন, গরুর খাবার হিসেব করে দেওয়া, মাছের পিএইচ মাপা, কিংবা মুরগির বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটর ব্যবহার—সব কিছুতেই তিনি আধুনিকতা এনেছেন।
জুয়েল আহমেদ জানান, চ্যালেঞ্জিং পেশা সাংবাদিকতা। তারও পর রংপুর বিভাগীয় শহরে সাংবাদিকতা করলে যে টুকু সময় পান তখনি পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে ৬৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে আসেন খামারে। নীলফামারী আর রংপুরে স্থায়ী বসবাসের কারণে গ্রামের বাড়িটি ভূতুড়ে হয়ে ছিলো। পালাপার্বণ ছাড়া বাড়িতে খুব একটা আশা হতোনা। যদিও বৃদ্ধ মা মনোয়ারা বেগম (৭৬) এর মন টিকটো না শহরে। বার বার স্বামীর ভিটেতে মন পড়ে থাকতো আর শরীর থাকতো ইটপাথরের শহুরে। খামার তৈরির পর থেকে মায়ের মন বসেছে বাড়িতে। সবুজ প্রকৃতি আর প্রাণীদের কলকাকলিতে
আরমান/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর