
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় এবং সমতলে সাড়ে নয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সরনার্থী আশ্রয় নেওয়ায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় ক্যাম্পে খাদ্য সংকট, ওষুধের অভাব এবং অপরাধ বাড়ছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে স্থানীয়দের অর্থনীতি, জমি, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা সহায়তায় বৈশ্বিক তহবিল উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালে যেখানে মাথাপিছু খাদ্য সহায়তা ছিল ১২ ডলার, সেটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নেমে এসেছে মাত্র ৮ ডলারে। ক্যাম্পগুলোতে চিকিৎসা সেবা প্রায় নেই বললেই চলে, শিক্ষাব্যবস্থা সীমিত, এবং অপরাধ চক্র ভয়ংকর হয়ে উঠছে। জরুরি মানবিক সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটের অর্ধেকেরও কম সংগৃহীত হওয়ায় অনেক এনজিও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমে গেছে, এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উখিয়ার বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালীসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ত্রিপল দিয়ে তৈরি ক্যাম্পে ক্ষুধার্ত মুখ, অসুস্থ শিশু এবং অপরাধের ছায়া প্রকট। অন্যদিকে স্থানীয়দের চোখে জমি হারানোর কষ্ট এবং নিরাপত্তাহীনতার হাহাকার। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা আসার পর inicialmente যে মানবিক সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে তা হ্রাস পেয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত আট বছরে আশ্রয় শিবিরগুলোতে ২৫১ জন রোহিঙ্গা নাগরিক খুন হয়েছেন। সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। এছাড়া, আশ্রয় শিবিরগুলোতে ৩ হাজার ৮২৩টি মামলায় ৮ হাজার ৬৮৯ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বেশিরভাগই উখিয়া ও টেকনাফের গহীন পাহাড়ে আত্মগোপন করে আছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা তাদের জমি দখল করে নিচ্ছে এবং পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করছে। স্থানীয় কৃষক মো. হানিফ জানান, প্রতিবাদ করতে গেলে বিভিন্ন সংস্থা তাদের সমর্থন দেয়ায় রোহিঙ্গারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
উখিয়ার পালংখালী, থাইংখালী ও বালুখালী এলাকার সাধারণ মানুষের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের চিকিৎসা, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। থাইংখালীর নারী রাশেদা বেগম বলেন, ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা বেরিয়ে এসে দোকান ও রিকশা চালাচ্ছে, ফলে স্থানীয় ছেলে-মেয়েরা কাজ পাচ্ছে না।
ক্যাম্পের বাসিন্দা হোসেন আরফাত জানান, তারা মিয়ানমারে গুলি খেয়ে বাংলাদেশে এসে ক্ষুধায় ভুগছেন, পাশাপাশি কিছু লোক গ্যাং তৈরি করে তাদের ওপর রাজত্ব করছে।
স্থানীয় কৃষক মিজানুর রহমান জানান, বালুখালী এলাকায় তার দুই একর জমি রোহিঙ্গারা দখল করে নিয়েছে এবং বসতি স্থাপন করেছে।
উখিয়া-টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তবে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পুরো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
মানবাধিকার কর্মী লায়লা নাসরিন বলেন, এটি শুধু শরণার্থী সমস্যা নয়, এটি একটি ভয়াবহ মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট। স্থানীয়দের বাঁচাতে জরুরি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
স্থানীয়রা জানান, উখিয়া-টেকনাফের শান্ত পাহাড় এবং সরল মানুষদের মধ্যে এখন অনিশ্চয়তা, হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। ক্যাম্পের ভেতরে ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতা, আর ক্যাম্পের বাইরে জমি ও জীবিকা হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ একা এই বোঝা বইতে পারবে না। রোহিঙ্গা সংকট এখন কেবল মানবিক নয়, এটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, এই বিশাল সংকট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। অনেক ক্যাম্প এখন অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে। জরুরি পরিকল্পনা ও আন্তরিকতার অভাবে কক্সবাজারসহ পুরো দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর