বাংলাদেশের এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরা আজ এক নীরব বঞ্চনার শিকার। যাদের কাঁধে আগামীর প্রজন্মকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব তারাই আজ তাদের দায়িত্ব ফেলে নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নেমেছেন রাস্তায়।
অথচ তাদের অধিকাংশ দাবিই ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নেও সরাসরি সম্পর্কিত। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে শিক্ষার মানোন্নয়নে জবাবদিহিতামূলক পাঠদানে শতভাগ প্রত্যাশা থাকলেও প্রত্যাশা পূরণে যেন আশার মুখে গুড়ে বালি।
এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য সম্মান,প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে তারা তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে শতভাগ প্রত্যাশা পূরণে মনোনিবেশ করতে পারছেন না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজ। অতীতের মতো সাম্প্রতিক সময়েও শিক্ষকদের বিভিন্ন আন্দোলন, বিক্ষোভ ও দাবি-দাওয়ার খবরাখবর দেশে নতুন নয়।
চলমান আন্দোলনে তাদের পেশাগত ভাবে একাডেমিক যোগ্যতার ভিত্তিতে তুলনামূলক অন্যসব সরকারি চাকরিক্ষেত্রগুলোর বেতন অবকাঠামো লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হয় যে- তাদের এ দাবি আদায়ের আন্দোলন বিলাসিতা নয় বরং বাস্তবসম্মত যৌক্তিক। কারণ এ আন্দোলন তাদের জীবন-জীবিকায় মর্যাদার সাথে টিকে থাকার লড়াই।
এজন্য সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের গভীর মনোযোগের সহিত ভাবা উচিত যে- শিক্ষকতা শুধু নিছক একটি পেশার নাম নয়; এটি একটি শিক্ষিত সমাজ বিনির্মান ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে এ মহান কারিগরের নাম। সেই মহান কারিগর শিক্ষক সমাজ যদি মর্যাদা ক্ষুণ্ণ কিংবা অবমূল্যায়িত হন তবে সেই প্রত্যাশিত জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষিত সমাজ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র বিনির্মান কখনো সম্ভব নয়।
অথচ দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে দেখা যায়- সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে তাদের বেতন,পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বিশাল ব্যবধান! শুধু তাই নয়- অনেকেই মাসের পর মাস বেতন বঞ্চিত,কারো চাকরি স্থায়িত্বহীন, আবার কেউ কেউ অবসরে গিয়েও পেনশন নিয়ে ভোগেন নানা জটিলতায় ! এই বাস্তবতার নিরিখে যখন শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য দাবি নিয়ে রাস্তায় নামেন- তখন তাদের প্রতি সমাজের একাংশের উদাসীনতা ও প্রশাসনিক অনীহা হতাশাজনক। আমরা ভুলে যাই- একজন শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না; তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার একমাত্র কারিগর।
রাষ্ট্র যদি একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রাপ্য অধিকার,সম্মান ও সুবিধা দিতে পারে, তবে শিক্ষক সমাজের বেলা কেন নয়? তাই সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে- শিক্ষকদের দাবী মানে এটি শুধু তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়- বরং এটি একটি জ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষিত জাতি গঠন ও পুরো শিক্ষাব্যবস্থার স্বার্থ, যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের স্বার্থও বিদ্যমান।
তাই সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতি বাজেটে বাজেট বাড়ালেও বাজেটের একটা বড় অংশ শিক্ষায় অবকাঠামোগত দিক সহ প্রকল্প ও প্রশাসনিক ব্যয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। আর শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়নে প্রশিক্ষণ, বেতন কাঠামো বা কল্যাণ তহবিলের দিকে তাকালে মূল বরাদ্দের তুলনামূলক অল্প বরাদ্দ চোখে পড়ে। অথচ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়- যে সব দেশ জ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক অগ্রসর তারা প্রথম অগ্রাধিকার দিয়েছে শিক্ষকদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন-জীবিকা ও তাদের প্রাপ্য অধিকারকে। কারণ তারা বোঝে- শিক্ষকতা শুধু সম্মানজনক পেশাই নয়, বরং সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা।
সেজন্য তারা জ্ঞান ভিত্তিক নাগরিক, সুশীল সমাজ,শিক্ষিত সভ্য জাতি ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে হতাশা মুক্ত শিক্ষকদের ন্যায্য সম্মান ও তাদের প্রাপ্য অধিকারকে প্রাধান্য দেয়। তাই সময় এসেছে- শিক্ষকদের আন্দোলন ঘিরে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তা নিরসনে সরকার ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা,সৌহার্দ্যবোধ ও নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা।
এইজন্য যে- শিক্ষকদের বঞ্চনা শুধু তাদের জীবনে নয়, শিক্ষার্থীর মনেও প্রতিফলিত হয়। একজন শিক্ষক যখন অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তায় ক্লান্ত হয় তখন তাঁর মনোযোগ শ্রেণিকক্ষে পুরোপুরি থাকে না। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো প্রজন্মের উপর। অর্থাৎ শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়া মানে আসলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করা। তাই শিক্ষকদের আন্দোলনকে দমন বা উপেক্ষা করা নয়, বরং তাদের সঙ্গে সম্মানের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে আলোচনায় বসা উচিত। প্রয়োজনে ধাপে ধাপে বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা যেতে পারে যাতে- সরকারি বাজেট, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও শিক্ষকদের ন্যায্য চাহিদা সবই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিবেচনায় আসে।
সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে- শিক্ষকরা ক্ষমতার লোভে রাস্তায় নামেনি,তারা নেমেছে নিজেদের ন্যায্য সম্মান ও প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। তারা রাষ্ট্রের শত্রু নন- তারা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কারিগর। তাদের চোখে পানি মানে পুরো জাতির অপমান। তারা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হলে শিক্ষার্থী শিক্ষা বঞ্চিত হয়,আর শিক্ষার্থী শিক্ষা বঞ্চিত হলে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় জাতি।
তাই জাতির আলোর দিশারি শিক্ষকদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। এমতাবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান সংকট উত্তরণ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের দাবীগুলোকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে- শিক্ষকদের দাবী আদায়ের এ আন্দোলনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে না দেখে একটি ন্যায় ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সহযোগিতার অংশ হিসেবে দেখা।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
খোলা কলাম এর সর্বশেষ খবর