দীর্ঘ সতেরো বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোটি কীভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, সেই ঐতিহাসিক পটভূমি আজ আমাদের সামনে এক গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবে আওয়ামী লীগ সরকার বিভোর ছিল, তার ফলশ্রুতিতে জনগণের মৌলিক ভোটাধিকার হরণ হয় এবং সংবিধানের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির মাধ্যমে সরকার পরিচালনার যে পথটি উন্মুক্ত হয়েছিল, তা ছিল দেশের গণতন্ত্রের জন্য এক অশনিসংকেত। ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো ছিল সেই একনায়কত্বের প্রবণতার সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ভোটকেন্দ্র দখল, রাতের আঁধারে ব্যালট বাক্স ভরাট এবং মনোনীত প্রার্থীকে এমপি বানানোর মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
ক্ষমতার এই দাপুটে আবহে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে গুম, খুন, চাঁদাবাজি, লুণ্ঠন ও দখলদারির রাজনীতি এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। ভিন্নমতের ওপর নির্মম নির্যাতন ও বাক্স্বাধীনতা হরণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সভা-সমাবেশের অধিকারকে পুলিশি পেটোয়া বাহিনী ব্যবহার করে কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। বিশেষত, আলেম-ওলামাদের প্রতি অমানবিক নিগ্রহ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগকে দিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করানো ছিল সরকারের দলীয় বৈষম্যনীতির নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং মডেল মসজিদের মতো কিছু উল্লেখযোগ্য ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করেছে। কিন্তু এই সব উন্নয়নকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। জনগণের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যকলাপের জবাবে এই উন্নয়নকে আবেগের বুলি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো, যেখানে দীর্ঘসূত্রিতা এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প উদ্বোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার কৌশল স্পষ্ট ছিল। এমনকি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলির নিম্নমানের নির্মাণশৈলী সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি করে।
দীর্ঘ সতেরো বছরের এই নিপীড়নের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার পর, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়। জনগণের বিজয়োল্লাস প্রমাণ করে, দেশের আপামর জনতা মুক্তি ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য কতটা উদ্গ্রীব ছিল।
স্বৈরাচারী শাসনের অপসারণের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে এক কঠিন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের সম্মুখীন। বিশেষত, এই সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে থাকা কিছু ব্যক্তির পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং সামগ্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার পদ্ধতি নিয়ে প্রজ্ঞাবান জনসমষ্টির মধ্যে গভীর প্রশ্ন ও সংশয় বিরাজ করা স্বাভাবিক।"
কিন্তু সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর দেশের বিভিন্ন মহলে যেই লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, খুন ও দখলদারির রাজনীতি পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও উদ্বেগের বিষয়। দেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর নাম ধরে ওঠা এসব অভিযোগ প্রমাণ করে, ক্ষমতার লোভ যে-কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের চরিত্রকে কলুষিত করতে পারে। যদিও ঊর্ধ্বতন নেতারা তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক কৌশল এবং ভবিষ্যৎ অবস্থান নিয়ে জল্পনা বাড়িয়েছে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল ম্যান্ডেট হলো দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রের সংস্কারমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করা এবং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। বর্তমানে দাবি-দাওয়ার নামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশের প্রজ্ঞাবান জনসমষ্টি এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা স্বৈরশাসনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন— তারা যদি পূর্ববর্তী সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব অথবা চাঁদাবাজি, লুণ্ঠন ও গুমের রাজনীতি অবলম্বন করে, জনগণের বাক্স্বাধীনতা হরণ করে, তবে পাঁচ বছর তো দূরে থাক, তারা এই মাটিতে পাঁচ মাস টিকতে পারবে না। কাজেই, সময় থাকতে প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তিকে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং ন্যায়-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার মাঝেই সকল শাসকের স্থায়িত্ব নিহিত।
লেখক: আজাদ হোসেন
সাংবাদিক (সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা)।
(খোলা কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি২৪লাইভ ডট কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর