গভীরভাবে দেখলে জুলাই আন্দোলনে সাধারণ মানুষ কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেনি, জীবনও দেয়নি। এটা ছিল আমাদের দেখা, আমাদের চেনা, এবং আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে এক গণবিস্ফোরণ। যে রাজনীতি সামগ্রিকভাবে মানুষকে কিছু দিতে পারেনি বা মানুষের ন্যায্য প্রত্যাশার জায়গায় উল্লেখযোগ্য অর্জন দেখাতে পারেনি।
একইভাবে ১৯৭১ সালে মানুষ শুধুমাত্র একটি মানচিত্রের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, জীবন দেয়নি, সম্ভ্রম হারায়নি।
'৭১ আর '২৪ তুলনাযোগ্য নয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই মানুষ রাজপথে নেমেছে নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির আশায়। কিন্তু আমরা দুর্ভাগা। সেই মুক্তি মেলেনি। উপরন্তু রাজনীতি আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। সেই বিভেদ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে সমাজের প্রতিটি স্তরে আঘাত হেনেছে। রাজনীতির নামে আমরা শোষিত হয়ে গেছি, যাচ্ছি অবিরাম।
সেই বাংলাদেশে জাতীয় কণ্ঠস্বর হয়ে উঠে এসেছিলেন শরীফ ওসমান হাদী নামক এক টগবগে যুবক। কবি নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা যেন তাঁর জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল। যাঁর রাজনীতি গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। মানুষ যাকে তাদের সন্তান ভাবতো, ভাবতো নিজেদের কণ্ঠস্বর। কিন্তু ২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর আততায়ীর গুলিতে স্তব্ধ হতে হয় তাঁকে। ১৮ই ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ২০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত জানাজায় অংশ নেওয়া লাখো জনতা প্রমাণ করে হাদির গ্রহণযোগ্যতা। সেই জানাজায় লাখো মানুষ সশরীরে অংশ নিলেও, সেদিন এই দেশের মুক্তিকামী লাখো কোটি মানুষ তাঁর জানাজায় শরিক হয়েছেন মনস্তাত্ত্বিকভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত হয়েছেন তিনি। নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত ওসমান হাদির সেই কবরটা দূর থেকে দেখেও তাঁর জন্য দোয়া করতে প্রতিদিন সেখানে যাচ্ছেন শত শত মানুষ। কোনো বাবা বলছে তার ছেলেকে সে হাদির মতো করে তৈরি করবে, বলছে তার সন্তান মারা গেলেও এতটা আঘাত তিনি পেতেন না। কোনো মা ওসমান হাদিকে বলছেন 'আমার হাদি'। এভাবে সবার সন্তান, সবার ভাই, সবার বন্ধু হয়ে ওঠা নিশ্চয় সাধারণ কোনো বিষয় নয়। যা প্রমাণ করে সত্যিই হাদি বাংলাদেশের মানুষকে পাগল বানিয়ে দিয়ে গেছেন। স্বল্প সময়ে হাদি যা কিছু বলে যেতে পেরেছেন তা মুক্তিকামী জনতাকে উজ্জীবিত করবে আগামী দিনগুলোতে।
হাদি বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশে একটি মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লব না হলে, সাংস্কৃতিক বিপ্লব না হলে প্রকৃত মুক্তির পথটি সুগম হবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতিকে সংস্কৃতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে, দর্শনকে দর্শন দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। সেই লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ঢাকা ৮ আসনে সংসদ সদস্য পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তিনি। যদিও এমপি হওয়াটাকে তিনি খুবই ছোট অর্জন বলে মনে করতেন। নির্বাচনী প্রচারণাকালে বিত্তবান থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষ, ঘরের মা-বোন তাঁর পকেটে টাকা গুঁজে দিয়েছেন। হাদিও তাদের আপ্যায়ন করেছেন মুড়ি-বাতাসা দিয়ে। সামান্য মুড়ি-বাতাসার সেই আপ্যায়ন মানুষ লুফে নিয়েছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইল দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গায় পৌঁছতে চেয়েছিলেন শহীদ শরীফ ওসমান হাদি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু তিনি এই দেশ, এই দেশের মানুষকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়ন করার লড়াইটা নিজে চালিয়ে যেতে পারলেন না।
বাংলার ঘরে ঘরে অতিথি আপ্যায়নে, গল্পে, আড্ডায়, রাজনীতির ময়দানে মুড়ি-বাতাসার প্রচলন চালু হোক। আপ্যায়নে মুড়ি-বাতাসার প্রচলনে আমরা যেন স্মরণ করতে পারি আমাদের একজন হাদি ছিলেন। আর এভাবেই জারি থাকুক মুক্তির আলোচনা, ইনসাফের আলোচনা।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর