ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সোমবার শাহবাগ অবরোধ করে রাখে জাতীয় ছাত্রশক্তি। আবরোধ থেকে সরলেও আগামীকাল বুধবার ফের শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি পালন ঘোষণা দেওয়া হয়।
সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন জাতীয় ছাত্রশক্তির সদস্যসচিব জাহিদ আহসান। কর্মসূচি ঘোষণা পরপরই তারা শাহবাগ মোড় ছেড়ে দেন। এসময় জাহিদ আহসান বলেন, ‘আজকের আইনশৃঙ্খলা অবনতির যে পরিস্থিতি এর দায় এই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার। এই উপদেষ্টা কঠোর হওয়ার পরিবর্তে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে বউ-বাচ্চা ও খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেন।
এটি তারা দূর্বলতা। সেই সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা লক্ষ্য করেছি। শরীফ ওসমানকে যারা গুলি করেছিলেন, তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কিন্তু পরে জামিন দেওয়া হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমরা বিশ্বাসী কিন্তু ৪ ঘণ্টায় ৮০০ মামলায় শুনানি-জামিন কিভাবে হয়? তাদের এই উদাসীনতার ফল আজকের গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসামন হাদি। তাই আর কোন সন্ত্রাসীকে জামিন দেওয়া চলবে না। যদি হয় তখন আমরা আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল পদত্যাগ চাইতে বাধ্য হবো।’
কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি আরও বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে চলমান আন্দোলন সেটি বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর স্থগিত থাকবে এবং আগামী ১৭ ডিসেম্বর আবার শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি পালন করা হবে।’
এর আগে ছাত্রসংগঠনটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘এই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্যর্থ। তিনি অনবরত নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে যাচ্ছেন। এ ব্যর্থ উপদেষ্টার আর গদিতে থাকার সুযোগ নেই। এর মাঝে আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রধান তিনিও উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। তিনি বলেলেন কি, হাদীর উপর গুলির ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা মানে, আওয়ামী লীগকে সুযোগ দেওয়া, আমরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাই। হাদির উপর শুধু এই গুলি করা হয়নি, এই গুলি করা হয়েছে ছাত্র-জনতার উপর। আমাদের দুটি দাবি সুস্পষ্ট, তাই অবিলম্বে হাদির খুনীদের গ্রেপ্তার করতে হবে এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।’
এইদিন বেলা ১১টার দিকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে জাতীয় ছাত্রশক্তির নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। পরে বেলা ১২টা ১৫ মিনিটে তারা শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এতে শাহবাগ এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। অবরোধে ‘অ্যাকশন, অ্যাকশন, অ্যাকশন ডাইরেক্ট’, ‘হাদীর ওপর গুলি কেন, প্রসাশন জবাব চাই’, ‘এক-দুই-তিন-চার, জাহাঙ্গীর তুই গদি ছাড়’সহ নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়।
দাবি পূরণ না হলে ৩ উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি ডাকসু: হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারসহ তিন দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। এইদিন দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা ডাকসু ভবনের সামনে জড়ো হন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি বাংলা একাডেমি দোয়েল চত্বর হাইকোর্ট হয়ে ২ দফা পুলিশি বাঁধা উপেক্ষা করে শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান নেন। এর এক পর্যায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান ডাকসুর ১০ প্রতিনিধি। সেখানে ৩ দফা দাবি জানান তারা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ব্রিফিংয়ে ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমাদের দাবি অনতিবিলম্বে না মানা হলে এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান পরিবর্তন না দেখাতে পারলে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে।’
উত্থাপন করা দাবিগুলো হলো- ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষ হামলাকারী, পরিকল্পনাকারী ও সহায়তাকারী সকল সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রের সকল সংশ্লিষ্ট অর্গানকে দ্রুত জবাবদিহি, যদের গাফিলতি প্রমাণিত হবে, তাদের বিচারের মুখোমুখি। একই সঙ্গে যারা এই হামলাকে সমর্থন যুগিয়েছে, হাদি ভাই ও জুলাই বিপ্লবীদের হত্যাযোগ্য করে তুলেছে, সেই কালচারাল ফ্যাসিস্টদের সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ বয়কট করতে হবে। এসব ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান করতে হবে।
দ্বিতীয় দফায় রয়েছে- আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিষিদ্ধ লীগের বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক চিরুনি অভিযান শুরু। নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের সকল সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার এবং সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের অবহেলা আমরা আর সহ্য করব না। তিন নম্বর দাবি হলে- শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে রায় কার্যকর, গণহত্যাকারী সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রতিবাদে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা এবং অভিযুক্তদের ফেরত না দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না রাখা।
পরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ছোট ভাইয়ের (সাদিক কায়েম) প্রতিটি দাবি যৌক্তিক৷ এর আগেও আমরা আপনাদের সামনে বলেছি; এই পদক্ষেপগুলো আরও বেগবান করতে হবে৷ আমরা তাদের এই যৌক্তিক দাবি গুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করব৷’
পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শিক্ষা ভবনের সামনে এসে অবস্থা কর্মসূচি ত্যাগ করেন ডাকসু-হল সংসদের নেতারাসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
পদত্যাগ না করলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা- ছাত্র অধিকার পরিষদ: সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে পাঁচ দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর ক্যান্টিবে সংবাদ সম্মেলনে করে ছাত্র অধিকার পরিষদ। গতকাল সোমবার সকালে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক থেকে দেড় বছরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর গুলি চালানোর মতো ঘটনার পরও অপরাধীদের তাৎক্ষণিক গ্রেফতারে তিনি কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। তিনি যদি পদত্যাগ না করেন তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত ৫ দফা দাবিগুলো হলো- চরম ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীকে অবিলম্বে পদত্যাগ; ফ্যাসিবাদের প্রত্যক্ষ দোসর জাতীয় পার্টির সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ রোধে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় পরিপত্র জারি; আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের কোনো নেতা-কর্মী যেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে পরিপত্রের মাধ্যমে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ; সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং শরীফ ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টাকারী ভারতে পলাতক ফয়সাল করিম মাসুদ (দাউদ খান) ও আলমগীরকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে না আনা হলে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস বন্ধের উদ্যোগ এবং গত ২৯ আগস্ট ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ হামলায় জড়িত সকলের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে করে আসা দুই আততায়ীর একজন চলন্ত রিকশায় থাকা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেখানে অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন না হওয়ায় সোমবার দুপুরে হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর