
রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখন যেন নিয়মিত যানজট, দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক হয়ে উঠেছে। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে মূল সড়ক পর্যন্ত—প্রতিটি রাস্তায় দিনদিন ভয়ানক হয়ে উঠছে এ যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল। যে যেভাবে পারছে রাস্তায় নেমে পড়ছে ব্যাটারিচালিত এই রিকশা নিয়ে। ফলে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে তারা।
ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, গুলিস্তান, গাবতলী, আজিমপুর—এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া আচরণ চোখে পড়ে না। অলিগলি বা শাখা সড়ক থেকে হঠাৎ করেই মূল সড়কে উঠে আসে এসব রিকশা, কোনও ধরণের সিগনাল বা দৃষ্টিসীমার তোয়াক্কা না করেই। ট্রাফিক আইন তোয়াক্কা না করে এরা মাঝেমধ্যে উল্টো পথে চলে আসে, আবার অনেক সময় রাস্তার বিভাজকের ওপর দিয়েও রিকশাসহ যাত্রী নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে।
ফলাফল—নিয়মিত সংঘর্ষ। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও এই বাহনের সঙ্গে প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগছে। ছোটখাটো দুর্ঘটনা গড়াচ্ছে হাত-পা ভাঙার মতো জখমে। চালক ও যাত্রীরা দু'পক্ষই আহত হচ্ছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন স্থানীয় ক্লিনিকে বা হাসপাতালে। অনেক সময় এসব দুর্ঘটনার পর রাস্তায় সৃষ্টি হচ্ছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। চালক ও যাত্রীর মধ্যে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা, এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত পৌঁছায়।
প্রাইভেট গাড়িচালকরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এতটাই এলোমেলোভাবে চলে যে, কখন কোন দিক থেকে সামনে এসে পড়ে, বোঝা যায় না। মূল সড়কে চলাচলের কোনো অনুমোদন না থাকলেও এগুলো বীরদর্পে চলাচল করছে। ট্রাফিক পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করছে। অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশ এসব রিকশা ধরলেও পরে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতে করে চালকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একধরনের ‘দুর্নিবার দাপট’।
এই বাহনগুলো কোনও নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায় নেই—এটা এখন ওপেন সিক্রেট। সিটি করপোরেশন বলে, তাদের আওতায় কেবল পা-চালিত রিকশা রয়েছে। বিআরটিএ বলে, তাদের নীতিমালায় ব্যাটারিচালিত রিকশার কোনো স্থান নেই। ফলে কোন সংস্থা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটাই স্পষ্ট নয়। এই অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা ব্যবহার করে প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা রাস্তায় নামছে—দূষণ ছড়াচ্ছে, রাস্তার জায়গা দখল করছে, দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠছে।
শুধু যান্ত্রিক সমস্যা নয়, এসব অটোরিকশার চালকদের আচরণও প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্ঘটনার পর অনেক সময় দেখা যায় তারা যাত্রীদের উপর চড়াও হচ্ছে। আবার প্রাইভেটকার বা বাইকের চালক কিছু বললেই গালি-গালাজে লিপ্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে মারধরও করে। পথচারী ও সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, এসব চালকের বড় একটি অংশ কিশোর বয়সী, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং চালনার ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাস্তায় নামছে।
এদিকে, হাইকোর্ট থেকেও একাধিকবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এই নির্দেশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে নেই কোনো সমন্বয় বা আন্তরিকতা। বরং প্রতিবারই সিদ্ধান্ত থেমে গেছে দায় এড়ানো ও দায় চাপানোর খেলায়। ফলে এই যানবাহনগুলো ক্রমেই একটি ভয়াবহ সমস্যায় রূপ নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোরিকশা একটি দরকারি বাহন হতে পারে যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে এরা আইনবহির্ভূতভাবে ও খেয়ালখুশিমতো চলাচল করছে, তা শুধু দুর্ঘটনা নয়—পুরো পরিবহন ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে তুলছে। অবিলম্বে এদের নিবন্ধন, চালকের প্রশিক্ষণ, নির্ধারিত রুট ও নির্দিষ্ট চলাচলের নিয়ম চালু না করলে, রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর