
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ‘সেভেন ডোর স্পা’সহ একাধিক স্পা সেন্টার এখন বিলাসবহুল দেহ ব্যবসা, ব্লাকমেইল ও মাদক কারবারের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। ম্যাসেজ ও থেরাপির নামে চলা এই ব্যবসার আড়ালে দিনের পর দিন নারীদের শোষণ, অবাধ যৌনতা এবং ভয়ংকর ব্লাকমেইলের ঘটনা ঘটছে। পর্যটক বা ভিজিটরদের গোপনে ভিডিও ধারণ করে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। অথচ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের আশ্রয় এবং পুলিশের নীরব সমর্থনে এই অপরাধ সাম্রাজ্য প্রতিনিয়তই আরও বিস্তৃত হচ্ছে, যা এখন কোটি টাকার রমরমা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। যা কক্সবাজারের মতো পর্যটন শহরের সুনামকে বিপন্ন করে তুলেছে।
শহরের হোটেল দেলোয়ার প্যরাডাইজে অবস্থিত ‘নিউ সেভেন ডোর স্পা’তে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে বিভিন্ন ধরনের ‘সেবা’। ফুল বডি ম্যাসেজের নামে চালানো হয় যৌনতা, ঘণ্টাভিত্তিক সেবার রেট ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত।
শহরের সেভেন ডোর স্পা একটি অস্বাভাবিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, যেখানে রোহিঙ্গা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেয়েরা এনে ইয়াবা সরবরাহ এবং অন্যান্য অবৈধ ব্যবসা চলছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন সোহেল তন্মী, যিনি স্পা-র আড়ালে একাধিক অবৈধ কাজ পরিচালনা করছেন।
বিশেষভাবে, সোহেল তন্মী স্পা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মেয়েকে ব্যবহার করছেন, যার মধ্যে মুন্সিগঞ্জের মনি, কক্সবাজার শহরের তানজিনা, খুলনার হীরা, বরিশালের সুমি, ফেনীর সোনিয়া এবং রাঙ্গামাটির মিমি রাখাইন অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে তানজিনা স্থানীয় পরিচয় ব্যবহারের মাধ্যমে সোহেল তন্মীর মেয়েটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, এবং এই মেয়েদের বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া, একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আবুল হাসেম নামের একজন পর্যটক সেভেন ডোর স্পা'র সেবা গ্রহণ করতে গেলে, সেখানে থাকা কর্মীরা তাকে ভিডিও ধারণ করে পুলিশের হুমকি দিয়ে ৩৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। মোবাইল ফোনে ওই ভুক্তভোগী তার অভিযোগ জানান, যা স্পার অবৈধ কার্যক্রমের আরও এক ভয়ানক দিক তুলে ধরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হোটেল-মোটেল জোনে এমন অন্তত ২২টি স্পা চালু আছে যেগুলোর বেশিরভাগই নিবন্ধনহীন। অধিকাংশ পরিচালিত হয় তরুণী ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীদের দিয়ে। ব্যবস্থাপনায় নারী কর্মীদের সামনে রাখা হলেও আসল মালিকানা থাকে কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং ‘ক্রাইম প্রোটেকশন’ হিসেবে দায়িত্বরত অসাধু পুলিশ সদস্যদের হাতে।
শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনে প্রায় ২২টি অবৈধ স্পা সেন্টার গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে বেশ কিছু নাম বেনামে চালু আছে। এসব স্পা সেন্টারগুলোর মধ্যে সিলভিয়া রিসোর্টের দ্বিতীয় তলায় সাথীসহ যৌত মালিকানাধীন ‘গোল্ডেন স্পা’ অন্যতম, যেখানে স্থানীয় মসজিদ কমিটির সদস্য ও সৈকত পাড়া বাসীরা এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে এলাকা থেকে বন্ধ করার দাবি তুলেছেন। এছাড়াও, সৈকত পাড়া কক্স অবকাশ হোটেলে ‘লাক্সারি থাই স্পা’, জিনিয়া রিসোর্টে ‘স্মার্ট থাই স্পা’, হোটেল হোয়াইট বিচে ‘এভ্যালা টাচ থাই স্পা’ এবং লেগুনা বীচ হোটেলে ‘নিউ সেভেন এসকে থাই স্পা’-এর মতো স্পা সেন্টারগুলো আলোচনায় রয়েছে। এছাড়া, অন্যান্য স্পা সেন্টারগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রিলোক্স থাই স্পা’, ‘এ্যরোমা থাই স্পা’, ‘থাই মেলোডি স্পা’, ‘ব্ল্যাক রোজ খাই স্পা’, ‘এঞ্জেল টাচ’ ইত্যাদি।
এমনকি একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই স্পা সেন্টারগুলোর বেশিরভাগই প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে। এসব স্পা সেন্টারগুলো গেস্ট হাউস ও অভিজাত হোটেলগুলোর মাসিক রুম ভাড়া নিয়ে যৌন উত্তেজক সেবা দিয়ে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে। মূলত, ধনাঢ্য পরিবারের সদস্য, কিছু পর্যটক এবং এনজিও কর্মীরা তাদের গ্রাহক। ফুল বডি ম্যাসেজের জন্য এখানে দাম ২০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়, যেখানে প্রতিটি স্পা সেন্টারে ১০-১৫ জন সুন্দরী নারী থাকে, বিশেষ করে রাখাইন নারী।
ঢাকা থেকে আসা এক পর্যটক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “ম্যাসেজের নামে প্রথমে কোমল ব্যবহার, তারপর সরাসরি ‘স্পেশাল অফার’। প্রস্তাব পছন্দ হলে, রুমেই চালানো হয় পুরো সেবা। কিছুক্ষেত্রে ইয়াবা সেবনের প্রস্তাবও আসে।”
তিনি বলেন, “একটি মেয়ে জানায়, মাসে ২০-২৫ জন ক্লায়েন্ট ম্যানেজ না করলে তাকে কটূক্তি করা হয়, বাসায় যেতে দেয়া হয় না।”
পুলিশের একটি সূত্র বলেন, “উর্ধ্বতনদের অনুমতি ছাড়া এসব স্পা’তে অভিযান চালানো কঠিন। কিছু জায়গায় ‘উপরের চাপ’ থাকে।”
কক্সবাজার পৌরসভার একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা শুধু ট্রেড লাইসেন্স দেই। স্পা বা ম্যাসেজ থেরাপির বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন।”
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, “কক্সবাজারে পর্যটনের নামে যে নৈতিক অবক্ষয় চলছে তা দুঃখজনক। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া কেউ স্থায়ী হোটেল, স্পা বা থেরাপি খুলতে পারে না। এখানে শিথিলতা বড় সমস্যা।”
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন আহমেদ সোহেল বলেন, “বডি ম্যাসেজের আড়ালে পতিতাবৃত্তি চালানো হলে সেটা ‘মানব পাচার ও দেহ ব্যবসা দমন আইনে’ স্পষ্ট অপরাধ। এক্ষেত্রে স্পা চালানোর মালিক, গেস্ট হাউস মালিক এবং আশ্রয়দাতা সবাই আইনের আওতায় পড়বেন।”
স্থানীয় সাংবাদিক তারেক আজিজ বলেন, “সেভেন ডোরসহ কক্সবাজারের স্পা সেন্টারগুলো আসলে যৌনবাণিজ্যের ঘাঁটি। দ্রুত প্রশাসনের পদক্ষেপ না নিলে কক্সবাজার শুধু ‘পর্যটন শহর’ নয়, ‘অনৈতিক শহর’ হিসেবে পরিচিতি পাবে।”
এ বিষয়ে কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “স্পা সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম আমাদের নীতির পরিপন্থি। আমরা দ্রুত এই সমস্ত স্পা সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব এবং আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করবো। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সুনাম রক্ষায় আমরা কোনো ধরনের অপরাধ বা অসামাজিক কর্মকাণ্ড সহ্য করবো না।”
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর