
দীর্ঘ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই ফের জনমনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ৫ই আগস্ট ২০২৪-এর ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বেই দলটির কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, হুমকি-ধামকি, ভয়ভীতি ও প্রভাব বিস্তারের নানা অভিযোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও ভয়ের জন্ম দিয়েছে। দেশের একটি বৃহৎ এবং জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণে দলটি ব্যর্থ হয়ে উল্টো জনমনে অসন্তোষ তৈরি করছে বলে মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর দেশে যখন একটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন বিএনপি একটি দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে অথবা সম্ভাব্য সরকার গঠনকারী দল হিসেবে দেশের উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু গত প্রায় এক বছরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং সাধারণ মানুষের অভিযোগ অনুযায়ী, দলের কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছোটখাটো সরকারি প্রকল্প থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন যে, বিএনপির স্থানীয় নেতারা তাদের ব্যবসার সুরক্ষার বিনিময়ে কিংবা প্রশাসনিক জটিলতা নিরসনের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করছেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে এবং নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া নিজ এলাকায় নিজেদের প্রভাব দেখাতে বিরোধী মতের মানুষকে হুমকি দেওয়া, তাদের ব্যবসা বা জীবিকায় বাধা সৃষ্টি করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় সালিশি ব্যবস্থায় অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ এবং নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে কিছু বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। এমনকি এলাকায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখলের ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “বিএনপি যদি সত্যিই দেশের নেতৃত্ব দিতে চায়, তাহলে তাদের এখনই এসব অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। একটি বড় দল হিসেবে তাদের কাছ থেকে মানুষ সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রত্যাশা করে। ক্ষমতায় আসার আগেই যদি তারা ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে, তাহলে ভবিষ্যতে জনগণের আস্থা অর্জন করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে এবং তার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পারে।”
সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক দলের একটি বড় অংশের মধ্যেই ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। তবে বিএনপির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ দলের কাছ থেকে মানুষ আরও পরিপক্ব ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তাদের দাবি, একটি মহল বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা এবং জনগণের অভিযোগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই বক্তব্যের অসামঞ্জস্যতা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
বিএনপি যদি সত্যিই জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায় এবং ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে চায়, তাহলে এখনই নিজ দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায়, “ক্ষমতায় আসার আগেই ক্ষমতা দেখাচ্ছে বিএনপি” – এই অভিযোগ তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে, যা দলটির জন্য মোটেই শুভ হবে না।
(খোলা কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি২৪লাইভ ডট কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
সর্বশেষ খবর