
‘জুলাই’ — কেবল একটি মাস নয়, বরং একটি দীর্ঘ বিদ্রোহের নাম। বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিতে জুলাই এখন ক্যালেন্ডারের পাতায় রক্তে লেখা এক দীর্ঘ আহাজারির নাম। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গুলিতে ঝরে পড়েছিল কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সেই রক্তের দাগ এখনো মুছে যায়নি। তার ঠিক এক বছর পর, ২০২৫-এর জুলাই মাসে আবারও কেঁপে উঠল জাতি—এইবার পুড়ে গেল শিশুর শরীর, পুড়ে গেল আমাদের বিবেক।
মাইলস্টোন স্কুলের ওপর আচমকা ভেঙে পড়ল একটি প্রশিক্ষণ বিমান। আগুনে মুহূর্তেই গলতে শুরু করল স্কুলের ছাদ, বেঞ্চ, বই আর শিশুদের তাজা শরীর। প্লাস্টিক গলে যাওয়া গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল দগ্ধ মাংসের ধোঁয়া। যারা বই হাতে স্কুলে গিয়েছিল, তারা ফিরে এল ছাই হয়ে। কেউ-বা ফিরলই না—নিঃশব্দ লাশ হয়ে রইল বার্ন ইউনিটের শীতল বিছানায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেল আগুনে কাঁপতে থাকা শিশুদের আর্তনাদ— কারো দৌড়, কারো চিৎকার "মা!", সেই ‘মা’ ডাক আজ গলে গেছে আগুনের শিখায়। বাতাস ভারী হয়ে আছে নিঃশব্দ শোকে। হাসপাতালের বারান্দায় মা-বাবার কান্নার টানে দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ছে, কেউ আর চিৎকারও করতে পারছে না— শব্দগুলো গিলে নিয়েছে অতীব বেদনা।
এত লাশের ভিড়েও রাষ্ট্র নির্বিকার। বারবার একই চিত্র—একই ‘তদন্ত কমিটি’, এক শোকবার্তা, এক ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এই লাশগুলো তো সংখ্যা নয়, এরা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গল্পগুলোর শুরু। এখন সেই গল্পগুলো শেষ হয়ে গেছে, আর আমাদের দায় মিটে গেছে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে, একটি কালো ব্যাজে।
প্রশ্ন একটাই—এই রাষ্ট্র, এই ব্যবস্থার ঘুম আর কত লাশ দেখলে ভাঙবে? জুলাই আমাদের কাছে এখন মৃত্যু উপত্যকা—আর এই শিশুদের স্বপ্ন, এ রাষ্ট্রে হয়তো তারা কোনোদিনই নিরাপদ ছিল না।
একটি প্রশিক্ষণ বিমান জনবহুল এলাকায় কেন উড়ছিল?
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান জনবহুল উত্তরায় কেন উড়ছিল? এটি কি নিরাপদ? আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও)-এর সুপারিশ অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য জনবিরল অঞ্চল নির্বাচন বাধ্যতামূলক। তা সত্ত্বেও কেন ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের অনুশীলন চালানো হচ্ছে?
আমরা কি শুধু তদন্ত কমিটি দিয়েই দায় এড়াব?
দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটি বৃত্তে ঘুরছি— শোক, কমিটি, বিস্মৃতি। প্রতিবারই একটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, শোক প্রকাশ করা হয়, ক্ষতিপূতির প্রতিশ্রুতি আসে। কিন্তু কয়টি তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে আসে? কয়টি সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়? দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটি বৃত্তে ঘুরছি—শোক, কমিটি, বিস্মৃতি। এই চক্র ভাঙতে না পারলে শুধু ঘটনা নয়, আমাদের ব্যর্থতার সংখ্যাও বাড়বে।
শিশুদের চিকিৎসায় রাষ্ট্র কতটা প্রস্তুত?
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহত শিশুদের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায়। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রচুর নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। স্বেচ্ছাসেবীরা প্রাণপণ চেষ্টা করলেও রাষ্ট্রীয় সমন্বয়ের ঘাটতি স্পষ্ট। প্রয়োজনে তাদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একটি শিশুর জীবনকে বাজেট বা প্রটোকল দিয়ে মাপা চলে না।
এত মানুষের ভিড়ে উদ্ধারকাজ কি বিঘ্নিত হয়নি?
উদ্ধারকারী দল দ্রুত কাজ শুরু করলেও সাধারণ মানুষের ভিড়ে কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ছবি তোলার প্রতিযোগিতা যেন একটি মর্মান্তিক ঘটনার মাঝেও ‘উৎসবে’ রূপ নেয়। এমন আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা শুধু উদ্ধারকাজকেই কঠিন করে তোলে না, মানবিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানবন্দর—এখনো কি বাস্তবতা?
মাদারীপুর-শরীয়তপুর সীমান্তে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বহু আগে নেওয়া হলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকায় বিমানবন্দর থাকার কারণে লাখো মানুষ প্রতিনিয়ত জীবন ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। আজকের দুর্ঘটনা সেই ঝুঁকির ভয়াবহ বাস্তব চিত্র।
এখন করণীয় কী?
ঢাকার আকাশে প্রশিক্ষণ বিমান চালানো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বিমান প্রশিক্ষণ ও বেসামরিক বিমান চলাচল জনবিরল বা গ্রামীণ এলাকায় স্থানান্তর করতে হবে। দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আহত শিশুদের উন্নত চিকিৎসা, প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় ট্র্যাজেডি থেকে কাঠামোগত শিক্ষা ও সংস্কার শুরু করতে হবে।
শেষ কথা:
আমরা আর একটি শিশুর মৃত্যুও দেখতে চাই না। চাই নিরাপদ আকাশ, সচেতন রাষ্ট্র, মানবিক শাসনব্যবস্থা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—নিরাপদ ভবিষ্যৎ। আজ যারা সন্তান হারিয়েছেন, তাদের শোক ভাষায় প্রকাশ করার নয়—কিন্তু এই শোক যদি আমাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে না বাধ্য করে, তাহলে সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহতা।
লেখক: রাশেদুল ইসলাম রাশেদ, সাংবাদিক ও শিক্ষক
সর্বশেষ খবর