
চাঁদাবাজি এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; বরং তা বাংলাদেশের সমাজে এক নিয়মিত ও উদ্বেগজনক শিরোনামে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্র খুললেই চাঁদা দাবি, হুমকি, এমনকি প্রাণনাশের খবর চোখে পড়ে। এই অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, যা জনজীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরে গভীর ছায়া ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, এই ধারাবাহিক চিত্রের শেষ কোথায় এবং এর সমাধান আদৌ সম্ভব কি না।
বাংলাদেশের সমাজে এক গভীর সংকট নীরবে শিকড় ছড়াচ্ছে—চাঁদাবাজি। এটি এখন শুধু গোপন গলিতে সংঘটিত ছিঁচকে অপরাধ নয়, বরং জনজীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিছু ক্ষেত্রে সংগঠনের ব্যানারে, আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাব খাটিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠে আসছে।
চলতি জুলাই মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া কিছু চাঁদাবাজির ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, যা সমাজের বর্তমান বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
গাজীপুরে চালকদের ভোগান্তি: গত ১১ জুলাই গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় রিকশা ও অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় এক শ্রমিক সংগঠনের নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে ১৩ জুলাই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। জানা যায়, চালকরা অনেক দিন ধরে এমন পরিস্থিতির মুখে ছিলেন, তবে অভিযোগ করতে সাহস পাননি। এই ঘটনা পেশিশক্তি ও সংগঠনের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির ভয়াবহতা এবং এর সাধারণীকরণের ইঙ্গিত দেয়।
পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পেছনে চাপ: গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিত্রফোর্ড এলাকার এক স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ সড়কে হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারান। যদিও হত্যার পেছনের কারণ অনুসন্ধানাধীন, তবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিনি ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধ ও চাঁদার দাবির মতো চাপের মধ্যে ছিলেন। এই ধরনের ঘটনাগুলো চাঁদাবাজির ভয়াবহতা এবং ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে তৈরি হওয়া আতঙ্কের দিকেই ইঙ্গিত করে।
গুলশানে চাঁদা দাবি, গ্রেপ্তার সংগঠনের নেতা: গত ১৭ জুলাই রাজধানীর গুলশান-২ এলাকার একটি বাসায় গিয়ে পাঁচ ব্যক্তি ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এবং ১০ লাখ টাকা নিয়ে চলে যায়। ২৬ জুলাই পুলিশ অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে। ঘটনার তদন্তে উঠে আসে, তারা একটি সামাজিক সংগঠনের সদস্য পরিচয় ব্যবহার করেছিল। সংগঠনটি পরবর্তীতে তাদের বহিষ্কারের ঘোষণা দেয় এবং সকল কার্যক্রম স্থগিত করে। এই ঘটনা দেখায়, সংগঠনের ছায়ায়ও কতটা সংগঠিত ও সুপরিকল্পিতভাবে চাঁদা আদায় হতে পারে।
একটি পরিবর্তনশীল চিত্র: আজকের চাঁদাবাজি আর আগের মতো নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখন এটি সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে—বাজার, পরিবহন, নির্মাণ, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও মাঝেমধ্যে এমন অভিযোগ আসে। এই চিত্র আমাদের ভাবিয়ে তোলে—চাঁদা আদায়ের এই চর্চা কীভাবে এতটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল? কেন মানুষ ভয় পায় মুখ খুলতে?
আইন প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ: যদিও কিছু ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবু সার্বিকভাবে আইন প্রয়োগে আরও কার্যকর ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ জরুরি। শুধু ঘটনার পর মামলা দায়ের বা গ্রেপ্তারে থেমে থাকলে চলবে না, বরং চাঁদাবাজির মূল উৎস ও পৃষ্ঠপোষকতাকে চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায় আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে আরও সরব ও সচেতন হতে হবে।
চাঁদাবাজি এখন কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, এটি আমাদের সমাজে একটি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, প্রতিবাদ না করি এবং প্রতিরোধ না গড়ে তুলি, তাহলে এটি ভবিষ্যতে আরও বড় সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। একটি সুশাসনভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান অত্যন্ত জরুরি। এই লড়াই শুধু প্রশাসনের নয়, আমাদের সবার।
✍️ লেখক: রাশেদুল ইসলাম রাশেদ
(খোলা কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি২৪লাইভ ডট কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
সর্বশেষ খবর